টিউলিপের পতন, এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১৫ এএম | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২০ এএম

রাজনীতি একটি নির্মম ক্ষেত্র। টিউলিপ (সদ্য পদত্যাগ করা ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক) এমন দুটি জগতের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে আলাদা নিয়মে খেলা চলে। এখন তার পরিবারের সুনাম বাংলাদেশ ও ব্রিটেন—উভয় জায়গায়ই কলঙ্কিত। আর তিনি কোনো জায়গাতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠী। তার মতে, বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে অদ্ভুতভাবে নীরব থেকেছেন টিউলিপ সিদ্দিক।

 

সলিল লিখেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। এ বিষয়টি সত্যিই অস্বাভাবিক। ড. ইউনূস বাংলাদেশে অর্থ পাচারকে ‘সরাসরি ডাকাতি’ বলে অভিহিত করে তা থেকে টিউলিপ সুবিধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এবং তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সঙ্গে টিউলিপের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বিপদে থাকা ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চীন সফরে যাওয়া সরকারি প্রতিনিধিদলে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং মন্ত্রীদের আচরণবিধি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে বিষয়টি তদন্তের জন্য তুলে দেন এবং অবশেষে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন। টিউলিপ তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।

 

চলতি মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, টিউলিপ তার খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনের কেন্দ্রে একটি দুই-বেডরুমের ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন। টিউলিপ দাবি করেন, এই ফ্ল্যাটটি তিনি তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। তবে ম্যাগনাসকে তিনি জানান, এই বাড়িটি যে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর উপহার ছিল, তা তিনি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন।

 

টিউলিপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত হ্যাম্পস্টেডে তার ছোট বোনের নামে থাকা আরেকটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। এই ফ্ল্যাটটিও হাসিনা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক ব্যবসায়ী উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ীর ভাড়া করা বাড়িতে বসবাস করছেন। ২০১৫ সালে সিদ্দিক প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়ের পর তিনি তার সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান, বিশেষ করে ব্রিটিশ আওয়ামী লীগের বাংলাদেশি সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।

 

টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে ২০১৩ সালের একটি ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ছবিটিতে তাকে তার খালা হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা গেছে। ছবিটি বাংলাদেশে ১২ বিলিয়ন ডলারের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তোলা। টিউলিপ দাবি করেন, এটি স্রেফ একটি পারিবারিক সফর এবং তিনি সেখানে গিয়েছিলেন পর্যটক হিসেবে। ম্যাগনাস তার ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। তবে এখন টিউলিপ বাংলাদেশের ওই চুক্তি নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের মুখোমুখি।

 

এদিকে, লরি ম্যাগনাস লন্ডনে টিউলিপের বাড়িগুলোর বিষয়েও কোনো নিয়ম ভঙ্গের প্রমাণ পাননি এবং লেনদেনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তার কাছে তথ্য ছিল সীমিত এবং টিউলিপের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট ভাবমূর্তি ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারতেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার টিউলিপের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চাইলে করতে পারেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, টিউলিপ পদত্যাগে বাধ্য হন।

 

সলিল ত্রিপাঠী আরও লেখেন, তবে হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে হয়তো বিষয়গুলো ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু গত বছর আগস্টে হাসিনার ক্রমবর্ধমান অজনপ্রিয় শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। হাসিনা সরকারের আমলে গুম, নিখোঁজ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে যায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়। ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। হাসিনা তার পিতার খ্যাতি পুনঃস্থাপনে অনেক কাজ করলেও তার শাসনামলের এত বিরোধিতা সৃষ্টি হয় যে, তার পতনের পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়।

 

সলিল লেখেন, মুজিবের অসম্মানের জন্য হাসিনা অনেকাংশেই দায়ী। তিনি নিজেকে সারা বিশ্বের কাছে ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলায় দৃঢ় অবস্থানে থাকা একজন নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো একজন শক্তিশালী মিত্র পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, টিউলিপ বহু জায়গায়, যেমন—সিরিয়া ও গাজায় মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয়ভাবে কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দ্রুত অবনতি হওয়া মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অদ্ভুতভাবে নীরব থেকেছেন এবং বারবার বলেছেন যে তিনি কেবল ‘একজন ব্রিটিশ এমপি’। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে টিউলিপের সম্পর্কই তার রাজনৈতিক জীবনে বিপদ ডেকে আনে।

 

বাংলাদেশে রেজিম পরিবর্তনের সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই প্রতিশোধ নিতে তাদের পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তদন্তের মাধ্যমে বিদ্বেষ চরিতার্থ করে থাকে। কিন্তু হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো (এবং টিউলিপ সম্পর্কে ওঠা প্রশ্নগুলো) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। রাজনীতিবিদদের অভিযোগ তোলার পেছনে যাই উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো—বিশ্বব্যাংক পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগের কারণে। এ ছাড়া হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষা কর্মীদের দমন করার ঘটনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।


বিভাগ : রাজনীতি


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

গুপ্ত হত্যা, গুম ও ক্রসফায়ার ছিলো শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়: রিজভী
ভ্যাট না বাড়িয়ে সরকারকে খরচ কমানোর পরামর্শ বিএনপির
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি: দোয়া চাইলেন তারেক রহমান
সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে অসন্তোষ বিএনপির
বাণিজ্য উপদেষ্টা কালোবাজারি সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন: ডা. ইরান
আরও

আরও পড়ুন

কালীগঞ্জে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা লাগাই প্রাণ গেল মোটরসাইকেল চালকের

কালীগঞ্জে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা লাগাই প্রাণ গেল মোটরসাইকেল চালকের

‘টিসিবির এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া’

‘টিসিবির এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া’

তারুণ্যের উৎসব যুব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিনে বেগমগঞ্জ বিজয়ী

তারুণ্যের উৎসব যুব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিনে বেগমগঞ্জ বিজয়ী

এক বছরে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

এক বছরে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

সুন্দরবনে বনদস্যু ও মাদক কারবারিদের ছাড় দেওয়া হবে না: খুলনা পুলিশ সুপার

সুন্দরবনে বনদস্যু ও মাদক কারবারিদের ছাড় দেওয়া হবে না: খুলনা পুলিশ সুপার

কিয়েভে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত চারজন, দাবি ইউক্রেনের

কিয়েভে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত চারজন, দাবি ইউক্রেনের

চাঁদপুরে ইলিশ গবেষণার নামে ৩৪ কোটি টাকা অপচয়

চাঁদপুরে ইলিশ গবেষণার নামে ৩৪ কোটি টাকা অপচয়

পঞ্চগড়ে গণসমাবেশে বক্তারা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষনার দাবী

পঞ্চগড়ে গণসমাবেশে বক্তারা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষনার দাবী

তারেক রহমানের পক্ষে পাইকগাছায় দুই সহস্রাধিক দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ

তারেক রহমানের পক্ষে পাইকগাছায় দুই সহস্রাধিক দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ

মার্কিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক অপসারণ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ক্ষোভ

মার্কিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক অপসারণ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ক্ষোভ

অল্পতেই গুটিয়ে গেল পাকিস্তান

অল্পতেই গুটিয়ে গেল পাকিস্তান

দয়া করে চোরদের আর আর ভোট দেবেন না : উপদেষ্টা সাখাওয়াত

দয়া করে চোরদের আর আর ভোট দেবেন না : উপদেষ্টা সাখাওয়াত

প্রতিবেদন দেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে : উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম

প্রতিবেদন দেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে : উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম

সিংগাইরে কৃষকদলের নতুন কমিটি গঠন

সিংগাইরে কৃষকদলের নতুন কমিটি গঠন

আরাফাত রহমান কোকো যুব ও ক্রীড়া সংসদের ময়মনসিংহ উত্তর জেলার কমিটি গঠন

আরাফাত রহমান কোকো যুব ও ক্রীড়া সংসদের ময়মনসিংহ উত্তর জেলার কমিটি গঠন

এটা সত্যি আমি ফেঁসে গেছি: সৃজিত মুখার্জি

এটা সত্যি আমি ফেঁসে গেছি: সৃজিত মুখার্জি

গাজার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ : আব্বাস

গাজার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ : আব্বাস

৩৯ হাজার ৯৯৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ উৎপাদন হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন চাউল

৩৯ হাজার ৯৯৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ উৎপাদন হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন চাউল

৪ আগস্টের পর মাজার-দরগাহে হামলা ভাঙচুর: গ্রেপ্তার ২৩

৪ আগস্টের পর মাজার-দরগাহে হামলা ভাঙচুর: গ্রেপ্তার ২৩

৭ ম্যাচে ৭৫২ রান, গড় ৭৫২- অবিশ্বাস্য করুনে মুগ্ধ টেন্ডুলকারও

৭ ম্যাচে ৭৫২ রান, গড় ৭৫২- অবিশ্বাস্য করুনে মুগ্ধ টেন্ডুলকারও